বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ খসড়া আজ শনিবার দেশের ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যা প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে।
এই খসড়ায় মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি প্রস্তাব বিষয়ে অবস্থান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশন আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে লিখিত মতামত জানাতে বলেছে।
খসড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত সনদ সংবিধান ও আইনের শীর্ষে অবস্থান করবে এবং এই সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এছাড়াও, সনদটি আইনি ভিত্তিতে প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা পাবে বলেও জানানো হয়েছে।
সনদে বলা হয়েছে কী কী সংস্কার হবে। সংলাপে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক দল এতে সই করে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে। অঙ্গীকারনামা শুরুতে অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গ্রহণ করা হয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ওই সময় পর্যন্ত সংবিধান না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মধ্যবর্তী সময়ের সব কাজকে আইনী ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়।
একইভাবে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া আইনী না হলেও রাজনৈতিক অঙ্গীকারে বৈধতা দেওয়া হয়। এ ধরনের বৈধতা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক কনভেনশন এবং গণতন্ত্রকে সংহত করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষাকে একইভাবে বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সনদের খসড়ায়।
অঙ্গীকারের প্রথম দফায় বলা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে সনদ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসেবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে রাজনৈতিক দলগুলো।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে জুলাই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলেও সনদ প্রাধান্য পাবে।
অঙ্গীকারের তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, সনদের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের থাকবে। প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, সনদ নিয়ে আদালতের প্রশ্ন তোলা যাবে না। পরে তা বাদ দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর তা আবার সংযোজন করা হয়েছে।
চতুর্থ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সনদের বিধান প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ গণ্য হবে। তাই সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, সনদ অনুযায়ী সংবিধান এবং আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন করা হবে।
পরের দফায় বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
সপ্তম দফায়, গণঅভ্যুত্থানে সকল হত্যার বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসনের অঙ্গীকার রয়েছে।
গত ২৮ জুলাই কমিশন দলগুলোকে যে নমুনা সনদ দিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল আগামী সংসদে গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। এতে বিএনপি রাজি হলেও জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল প্রত্যাখান করেছে। তারা সনদের আইনী ভিত্তি চায়।
অঙ্গীকারের অষ্টম দফায় বলা হয়েছে, সংস্কারের যেসব প্রস্তাব অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কালক্ষেপণ না করেই নির্বাচনের আগে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে।
যেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে- সেগুলো সংসদ গঠনের আগে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে- প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় এ পথ তৈরি হবে।
সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের বিরোধী বিএনপি। সনদের খসড়া পাওয়ার কথা জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি সমকালকে বলেছেন, সনদ পড়ে মতামত জানাবে বিএনপি।
সনদকে আইনীভিত্তি দেওয়ার বিধান খসড়ায় থাকায় জামায়াতের দাবির একাংশ পূরণ হয়েছে। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, দলীয় ফোরাম আলোচনা করে মতামত জানানো হবে।