রাজধানীর শাহবাগ থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলার সময় লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। বারবার আইনজীবী তার পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি জানিয়েছিলেন, আদালতের প্রতি তার আস্থা নেই এবং তিনি জামিন দেওয়ার ক্ষমতা স্বীকার করেন না। এজন্য তিনি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেননি।
শুক্রবার (২৯ আগস্ট) শাহবাগ থানার এসআই তৌফিক হাসান আদালতে আবেদন করেন, আসামিদের কারাগারে আটক রাখা হোক।
অন্য আসামিরা হলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন), মো. আব্দুল্লাহ আল আমিন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না, কাজী এ টি এম আনিসুর রহমান বুলবুল, গোলাম মোস্তফা, মো. মহিউল ইসলাম ওরফে বাবু, মো. জাকির হোসেন, মো. তৌছিফুল বারী খান, মো. আমির হোসেন সুমন, মো. আল আমিন, মো. নাজমুল আহসান, সৈয়দ শাহেদ হাসান, মো. শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার, দেওয়ান মোহম্মদ আলী ও মো. আব্দুল্লাহীল কাইয়ুম।
এদিন সকালে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। তাদের সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাদের এজলাসে তোলা হয়। এসময় তাদের হাতে হাতকড়া, মাথায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছিল। তাদের আসামির কাঠগড়ায় রাখা হয়।
তখনো তাদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানো ছিল। শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন) পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ভয়াবহ অবস্থা। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলি।’ তখন পুলিশ সদস্যরা তাদের জ্যাকেট খুলে দেন।
কাঠগড়ায় সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন লতিফ সিদ্দিকী। এসময় তাকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। পানি পান করেন। মাঝে মধ্যে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে ঢাকার মহানগর হাকিম সারাহ ফারজানা হক এজলাসে ওঠেন।
এসময় আদালতের অনুমতি নিয়ে আইনজীবীরা আসামিদের স্বাক্ষর নিতে চান। লতিফ সিদ্দিকী বাদে অন্য অধিকাংশ আসামিই ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেন। লতিফ সিদ্দিকীর কাছে সাইফুল ইসলাম সাইফ স্বাক্ষর নিতে যান। তবে তিনি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেননি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখিসহ অন্যরা জামিন চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
কারাগারে নেওয়ার পথে সাংবাদিকরা জানতে চান, তার কিছু বলার আছে কি না। তখন লতিফ সিদ্দিকী মাথা নাড়িয়ে জানান, তিনি কিছু বলবেন না। পরে তাকেসহ অন্যদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুনানি শেষে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম সাইফ জানান, ‘লতিফ সিদ্দিকীর জামিনের প্রার্থনা যখন তার কাছে ওকালতনামা স্বাক্ষর করতে যাই, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে। তখন তিনি বলেন, যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে কেন জামিন চাইব? আমি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করব না, জামিন চাইব না। যতবার স্বাক্ষর করতে যাই, ততবারই তিনি একথা বলেন, এ কারণে তিনি জামিনের প্রার্থনা করেননি। আদালতের প্রতি তার আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১ নামে একটি ব্যানারে গোলটেবিল আলোচনা চলছিল। এসময় একদল ব্যক্তি নিজেদের জুলাই যোদ্ধা পরিচয় দিয়ে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ১৬ জনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এদিকে গোলটেবিলের এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়।
আসামিদের কারাগারে আটক রাখার আবেদনে বলা হয়, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ‘মঞ্চ ৭১’-এর ব্যানারকে পুজি করে প্রকৃতপক্ষে দেশকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র ও উপস্থিত অন্যদের প্ররোচিত করে বক্তব্য প্রদান করছিল। তার এই ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্যের জন্য উপস্থিত লোকজন তাদের ঘেরাও করে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বলে স্লোগান দেয়। পরস্পর সহায়তাকারী হিসেবে দেশকে অস্থিতিশীল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনার অপরাধ করেছে। মামলাটি তদন্তাধীন। এমতাবস্থায় মামলাটি সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে মামলার তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই না হওয়ায় পর্যন্ত তাদের জেলে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ ছাড়া মামলার তদন্তের স্বার্থে পরে ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসামিদের পুলিশ রিমান্ডে পাওয়ার আবেদন করা হবে। পরে আসামিপক্ষে আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখিসহ অন্যরা জামিন চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা সুমন জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বন্ধের লক্ষ্যে গত ৫ আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সংগঠনের উদ্দেশ্য জাতির অর্জনকে মুছে ফেলার সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নেওয়া। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ২৮ আগস্ট সকাল ১০টায় একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সকাল ১১টায় ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর মধ্যেই এক দল ব্যক্তি হট্টগোল করে স্লোগান দিয়ে সভাস্থলে ঢুকে পড়েন। একপর্যায়ে তারা অনুষ্ঠানস্থলের দরজা বন্ধ করে দেন। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কয়েকজনকে লাঞ্ছিতও করেন। হট্টগোলকারীরা গোলটেবিল আলোচনার ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন এবং আলোচনায় অংশ নেওয়াদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে অতিথিদের অনেককেই বের করে দেওয়া হলেও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। পরে পুলিশ এসে ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশের উপপরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। পরে এ মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।